জুলাই সনদের খসড়া প্রস্তুত, পুলিশ কমিশনে ঐকমত্য
পুলিশ বাহিনীর পেশাদারত্ব ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং পুলিশি সেবাকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে একটি ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাবে গতকাল রোববার ঐকমত্য হয়েছে। জানানো হয়েছে জুলাই সনদের খসড়া প্রস্তুত করার কথাও। এ ছাড়া এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার ১৯তম দিন। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এখন পর্যন্ত ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল সকাল থেকে রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত আলোচনা চলে। মাঝে একাধিকবার বিরতি ছিল। এদিন সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন নিয়ে ঐকমত্য কমিশন একটি নতুন প্রস্তাব দেয়। সংবিধানের মূলনীতি নিয়েও আলোচনা হয়। তবে এ দুটি বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করা হবে।
গতকাল আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে ঐকমত্য কমিশন। আজ সোমবারের মধ্যে এই খসড়া দলগুলোকে পাঠানো হবে। জাতীয় সনদ সইয়ের জন্য চলমান আলোচনায় একটি দিন বরাদ্দ রাখা হবে।
এ সময় আলী রীয়াজ দলগুলোর উদ্দেশে বলেন, ‘সনদের বিষয়ে যদি বড় রকমের মৌলিক আপত্তি ওঠে, তাহলে আলোচনায় আনব, না হলে আনব না। আপনাদের পক্ষ থেকে মতামত দেওয়া হলে সেটা সন্নিবেশিত করে প্রাথমিক সনদে ভূমিকা-পটভূমি থাকবে এবং কমিটমেন্টের জায়গা থাকবে।’
পুলিশ কমিশন গঠন
গতকালের পুলিশ কমিশন গঠনের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। দলগুলোর পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ আসে। পরে প্রস্তাবটি সংশোধন করে আবার হাজির করা হয়। এটি নিয়ে আলোচনার পর অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৈঠকে বলেন, এ বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে।
প্রস্তাবে পুলিশ কমিশন গঠনের তিনটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। ১. পুলিশ যাতে আইনানুগভাবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়, তা নিশ্চিত করা। ২. পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের নিষ্পত্তি করা। ৩. নাগরিকদের পক্ষ থেকে পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্য–সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের নিষ্পত্তি করা।
আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রপ্ত বিচারপতি হবেন এ কমিশনের চেয়ারম্যান। সদস্যসচিব হবেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের নিচে নন, এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সদস্য হিসেবে থাকবেন সংসদ নেতার একজন প্রতিনিধি, বিরোধীদলীয় নেতার একজন প্রতিনিধি, জাতীয় সংসদের স্পিকারের একজন প্রতিনিধি, ডেপুটি স্পিকারের (বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত) একজন প্রতিনিধি, সচিব পদমর্যাদার নিচে নন, এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, জেলা জজ পদমর্যাদার নিচে নন, এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং একজন মানবাধিকারকর্মী। কমিশনের সদস্যদের ন্যূনতম দুজন নারী থাকবেন।
কমিশনের চেয়ারম্যানসহ কিছু সদস্য বাছাইয়ের জন্য একটি কমিটি থাকবে। সে কমিটির সদস্য হবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি।
পুলিশ কমিশনের কাজ কী হবে, সেটাও প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কোনো পুলিশ সদস্যের অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় শাস্তির মাত্রা নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া; পুলিশের কাজে বেআইনি প্রভাব বা হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা প্রদানে নির্দেশনা দেওয়া; পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে নাগরিকদের অভিযোগ আমলে নিয়ে যথাযথ তদন্তের ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া ইত্যাদি।
প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ মেয়াদ এবং স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য: আলী রীয়াজ
প্রধানমন্ত্রিত্ব সর্বোচ্চ ১০ বছর
এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, এ বিষয়ে আগেই একধরনের ঐকমত্য হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বিএনপি শর্তসাপেক্ষে প্রস্তাবটিতে রাজি হয়েছিল। গতকাল আলোচনার এক পর্যায়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা একটা বিষয়ে একমত হয়েছিলাম, কিন্তু সেটা বলা হয়নি। সেটা হলো প্রধানমন্ত্রী ১০ বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন। সনদে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর উল্লেখ করব।’
আলী রীয়াজ জানতে চান, সবাই এ বিষয়ে একমত কি না, বিএনপি যে শর্ত দিয়েছিল, সেটা এখনো আছে কি না।
পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তাঁরা বলেছিলেন, ১০ বছরের বেশি কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন না। সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের কমিটি থাকলে বিষয়টি বিএনপি মানবে না। তবে আলোচনায় সবার মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগসংক্রান্ত বিধান সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে বিএনপি একমত। এর বাইরে অন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হলে বিএনপির শর্ত বহাল থাকবে।
এটা বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘এখন ১০ বছরের বিষয়ে আপনারা ঘোষণা দিতে পারেন। বরং এটা আমাদের প্রস্তাব।’
গতকাল মাগরিবের নামাজের বিরতিতে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলো সব বিবেচনা পাশে রেখে একমত হয়েছে যে একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে যত মেয়াদ বা যতবারই হোক, সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন। এ জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী করা হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, যে দুটি বিষয় ঐকমত্য হয়েছে, সেটাকে বড় ধরনের অগ্রগতি মনে করে কমিশন। এর একটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী পদের ব্যাপারে শর্তহীনভাবে সবার একমত হওয়া। দ্বিতীয় হচ্ছে একটি পুলিশ কমিশন প্রতিষ্ঠা করা।
রাষ্ট্রের মূলনীতি
সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি কী হবে, তা নিয়ে আগে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল। গতকাল আবার আলোচনা হয়। কিন্তু দলগুলো মোটাদাগে আগের অবস্থানেই আছে। এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব হলো সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লেখিত হবে। এখন যে চারটি মূলনীতি আছে, সেগুলো থাকতেও পারে, না–ও থাকতে পারে, সে সিদ্ধান্ত হবে পরবর্তী সংসদে।
বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল কমিশনের প্রস্তাবের পক্ষে মত দেয়। এনসিপি আগের চার মূলনীতি পুরো বাদ দিয়ে কমিশন যে প্রস্তাব, সেটার সঙ্গে একমত। সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ, গণফোরাম সংবিধানের বিদ্যমান চার মূলনীতি বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়।
একপর্যায়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, যেসব দলের এ বিষয়ে দ্বিমত আছে তারা সনদে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দিতে পারে। এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তবে বাংলাদেশ জাসদ ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, এই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েও থাকা সম্ভব নয়। এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তারা পরবর্তী আলোচনায় থাকতে পারবে না।
আলোচনায় জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাঁরা কিছুটা বিব্রত বোধ করছেন। তাঁরা কর্মীদের প্রশ্নের মুখে পড়বেন যে বামপন্থীরা সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে আলোচনা করছে। যাঁরা ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’–এর পক্ষের, তাঁরাও শক্তভাবে দাঁড়িয়ে গেলে ভীষণ ব্যাপার হবে। বামপন্থীদের একটু সংযত হওয়া ভালো। দুই–তৃতীয়াংশ দল ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের’ পক্ষে। এটা পরিষ্কার, নির্বাচন হলে কোনোভাবে ওনাদের (বামপন্থী) প্রস্তাব টিকবে না। তাই তাঁরা (জামায়াত) জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন না।
মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সাংবাদিকদের বলেন, যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে জোর করে, শব্দের মারপ্যাঁচে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত চার মূলনীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়া হয়, সেটার সঙ্গে তাঁরা একেবারেই একমত নন। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে তাঁদের পক্ষে কমিশনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
সন্ধ্যায় আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে ঐকমত্যে আসা যাচ্ছে না। ফলে কমিশন এখন এটা পুনর্বিবেচনার জন্য নিয়ে গেছে। ৩১ জুলাইয়ের আগে এ বিষয়ে কমিশন একটি সিদ্ধান্ত দেবে বলে তিনি আশা করেন।
নারী আসন নিয়ে নতুন প্রস্তাব
সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০টি করা এবং সেখানে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল সংস্কার কমিশন। কয়েক দফা আলোচনায় নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় গতকাল নতুন প্রস্তাব দেয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে নারী আসন বাড়ানোর প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়েছে।
আলী রীয়াজ নতুন প্রস্তাব সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, নারীদের সংরক্ষিত ৫০টি আসন অব্যাহত রাখা হবে। এর বাইরে ৩০০ আসনের এক–চতুর্থাংশ বা এক–পঞ্চমাংশ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের জন্য দলগুলো যেন মনোনয়ন দেয়।
তবে এ নিয়ে গতকাল বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। আলোচনায় কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
News Courtesy: