আইনি ভিত্তি নিয়ে এখনো অনড় বড় দলগুলো

আইনি ভিত্তি নিয়ে এখনো অনড় বড় দলগুলো

জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়ার ওপর মতামত জমা দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-সহ ৫টি দল। অন্য দলগুলো হলো-এবি পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)। তবে মতামত জমা দেওয়ার সময় দুইদিন বাড়িয়ে শুক্রবার বেলা ৩টা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে রোববার আবারও বৈঠক করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় ও সর্বশেষ বৈঠক করবে কমিশন।

তবে সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলো যার যার অবস্থানে এখনো অনড়। এ অবস্থায় সংকট নিরসনে ৪টি বিকল্প দেখছে ঐকমত্য কমিশন। এগুলো হলো-গণভোট, সুপ্রিমকোর্টের মতামত, বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থা ও অধ্যাদেশ জারি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর।

জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করে। তাদের কর্মী-সমর্থক আছে। ফলে তারা সেভাবেই কথা বলে। তাদের এসব কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। কিন্তু এগুলোকে আমরা তাদের চূড়ান্ত মতামত হিসাবে বিবেচনা করতে পারি না। যতক্ষণ তারা লিখিত বক্তব্য আমাদের কাছে না পাঠায়, ততক্ষণ আমরা আপনাদের লেখা (গণমাধ্যমের সংবাদ) পড়ি। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। তিনি বলেন, শুরু থেকে রাজনৈতিক দলগুলো সহায়তা করে আসছে। ফলে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।

‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর সমন্বিত খসড়া শনিবার ৩৫টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এক্ষেত্রে খসড়ার ওপর নিজেদের মতামত জমা দিতে ২০ আগস্ট (বুধবার) বিকাল ৪টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে ৫টি দল তাদের মতামত দিয়েছে। তবে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অনুরোধে এ সময়সীমা শুক্রবার বেলা ৩টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে মতামত জমা দেওয়া দলগুলো হলো-বিএনপি, এবি পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং এনডিএম। তবে সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৮৪টি সুপারিশ বাস্তবায়নের তিনটি আইনি দিক রয়েছে। প্রথমত, বেশকিছু সুপারিশ নির্বাহী আদেশ দিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নে আইন পরিবর্তন বা নতুন আইন করতে হবে। তৃতীয়ত, মৌলিক সুপারিশ বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতেই হবে। এসব কারণে সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি। বিএনপি বলছে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব নয়। ফলে পরবর্তী সরকার তা বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি বলছে, নির্বাচনের আগে সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং নির্বাচন হতে হবে সনদের ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে সনদের একটি সুপারিশে বলা আছে, সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর (আনুপাতিক ভোট) পদ্ধতিতে সদস্য নির্বাচিত হবেন। বিএনপি এক্ষেত্রে আপত্তি দিয়েছে। তবে জামায়াত এবং এনসিপি শুধু উচ্চকক্ষেই নয়, নিম্নকক্ষেও পিআর চায়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্য রয়েছে। পাশাপাশি কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। তিনি বলেন, সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারকে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটিকে সাংবিধানিক রূপ দিতে হলে সংসদে যেতে হবে। বুধবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করারই সময় হয়নি। এখনো সনদের অনেক কিছু পরিষ্কার হয়নি। এদিকে দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো যখন এই সনদে স্বাক্ষর করবে, তখন আলাদা করে অঙ্গীকারনামার প্রয়োজন নেই। অঙ্গীকারনামা থাকলেও তা যুক্তিসংগত হতে হবে। এছাড়া কোনো রাজনৈতিক ‘সমঝোতার দলিল’ সংবিধানের ওপরে স্থান পেতে পারে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে তারা। বিএনপি মনে করে, জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হলে খারাপ নজির তৈরি হবে। এ সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, সরাসরি এমন বিধান রাখায় আপত্তি জানিয়ে মতামত দিয়েছে দলটি।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বুধবার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বলেন, পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন ভালো হবে না। প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের জীবনদানের কোনো মূল্য থাকবে না। তিনি বলেন, আমরা দলীয়ভাবে পিআর পদ্ধতির পক্ষে। সেক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান থেকে সরে আসার কোনো কারণ নেই।

জামায়াতের আরেকজন নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জুলাই সনদ দেশের ভবিষ্যৎ ও নির্বাচনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সনদের খসড়ার ওপর আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। এগুলো নিয়ে আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কথা বলব, মতবিনিময় করব। প্রধান ইস্যুগুলোয় আমরা (রাজনৈতিক দলগুলো) সবাই একমত হয়েছি।

এদিকে খসড়ায় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া না থাকায় গণমাধ্যমের কাছে হতাশা প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির যুগ্ম-আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় বাস্তাবায়নের প্রক্রিয়া বলা হয়নি। এর আগেও বেশ কয়েকবার বাস্তবায়ন পদ্ধতির কথা আমরা বলেছিলাম। তারপরও বাস্তবায়ন পদ্ধতির কথা সনদের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়নি। বরং অনেকটা গোঁজামিল দিয়ে দুটি জিনিস নিয়ে আসা হয়েছে। একটি হচ্ছে-যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য হবে, সেগুলো নির্বাচনের আগে সরকার বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়গুলো স্পষ্ট করেনি এবং সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, তাও স্পষ্ট করা হয়নি।

অন্যদিকে সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে রোববার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবারও বৈঠক করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমএ মতিন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন এবং ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকের সঙ্গে কমিশন বৈঠকে বসবে।

বহুল কাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর সমন্বিত খসড়া শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে সনদের যেসব সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়ার অঙ্গীকারে জুলাই সনদকে সর্বোচ্চ আইনি ভিত্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসাবে গণ্য হবে। ফলে এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। সনদের কোনো বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত যে কোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার থাকবে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের ওপর।

খসড়ায় তিনটি অংশ আছে। প্রথম অংশে সনদের পটভূমিতে ৫টি প্রস্তাবনা, দ্বিতীয় অংশে ঐকমত্য হওয়া ৮৪টি সিদ্ধান্ত এবং তৃতীয় অংশে রয়েছে ৮টি অঙ্গীকার। আবার ঐকমত্য হওয়া ৮৪টির মধ্যে ১৪টিতে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে।

News Courtesy:

Jugantor | August 21, 2025

 

 

An unhandled error has occurred. Reload 🗙