মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুর ঊর্ধ্বে, চব্বিশ অভূতপূর্ব: আলী রীয়াজ

মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুর ঊর্ধ্বে, চব্বিশ অভূতপূর্ব: আলী রীয়াজ

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে যারা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলেন, তাদের সঙ্গে একমত নন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, এমনকি একে বিপ্লব বলতেও তিনি রাজি নন।

তার ভাষায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ‘সব কিছুর ঊর্ধ্বে’। তবে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই যে ২০২৪ এর অভ্যুত্থানের উদ্ভব হয়েছে, সেটাও তিনি মনে রাখতে বলছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’এ অতিথি হয়ে এসেছিলেন যুক্তষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক, যিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে গিয়ে গণফোরাম সম্প্রতি অভিযোগ করেছে, সংস্কার প্রস্তাবে নাকি সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধকেই ‘বাদ’ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে আলী রীয়াজ বলছেন, এটা তাদের ‘বোঝার ভুল’।

“বোঝার ভুল এই কারণে যে আমরা যদি একাত্তরকে বাদ দিতে চাইতাম, তাহলে (সংবিধানের মূলনীতিতে) সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার কি থাকত? আমি বাহাসে যাচ্ছি না। রাজনৈতিক দল তাদের অবস্থান থেকে বলবেন। আমি সেজন্য বললাম যে বোঝার ভুল, কিছুতেই কিছু প্রতিস্থাপিত হচ্ছে না।”

আলী রীয়াজ বলেন, “৫ অগাস্টকে কেউ কেউ ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলেছেন। আমি কিন্তু একমত হইনি। ব্যক্তিগতভাবে বলছি, না- একাত্তর সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে।

তিনি বলেন, “অনেকে এটাকে বিপ্লব বলেছেন, আমি বলছি এটা গণঅভ্যুত্থান। এটাকে আমি বিপ্লব বলছি না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা, কিছুতে প্রতিস্থাপন করার কিছু নেই।

“আবার পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে আমরা চব্বিশে পৌঁছেছি। চব্বিশ তো অভূতপূর্ব, অভাবনীয়!”

এই অধ্যাপকের মতে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আবার ১৯৯০ সালের অভ্যুত্থানের মতও নয়। চব্বিশের উদ্ভব হয়েছে ‘রাষ্ট্র্রকাঠামো পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা’ থেকে।

“একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে কিছুতেই প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে না। ২০২৪ সালকে ছোট করা, খাটো করা, অস্বীকার করার কিছু নেই। এটাকে আবার অন্য যে কোনো আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলে এটার যে গুরুত্ব, সেটাকেও খাটো করা হবে।”

সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখন আলোচনা করছে ঐকমত্য কমিশন। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপের আলোচনা শেষ পর্যায়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ শেষ হলেই তৈরি হবে ঐকমত্যের দলিল।

দলগুলো কোন কোন বিষয়ে দ্বিমত করছে, সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথ কী হতে পারে, নির্বাচন কখন হলে ভালো, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিতর্ক, জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাসহ নানা বিষয়ে ইনসাইড আউটে খোলামেলা কথা বলেছেন আলী রীয়াজ।

বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।

‘দ্বিতীয় ধাপে পথপার্থক্য আরও কমবে’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে আলী রীয়াজই কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সংলাপের প্রথম ধাপে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কতটুকু এগোল, ইনসাইড আউটে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে।

তিনি বলেন, “অনেক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নীতিগত জায়গার দিক থেকে বেশ কিছু জায়গায় আমরা দেখতে পাচ্ছি যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে আছে।”

তার ভাষায়, ‘কমিটমেন্টের’ জায়গা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় সবাই একমত যে সংস্কার হতে হবে।

“প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে এবং সেই সংস্কারগুলো রাষ্ট্র কাঠামোয় পরিবর্তনের জন্য দরকার। তার মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুদক, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন রয়েছে।“

অনেক ক্ষেত্রে নীতিগত জায়গার সবাই একমত হলেও প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ থাকার কথা তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে মাত্রার হেরফের রয়েছে, কীভাবে এটা করা যায়। কিন্তু কমবেশি সব রাজনৈতিক দলের সবাই প্রায় নিশ্চিত, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।”

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এখন দলের বিপক্ষে ভোট দিলে বা দলের মনোনীত প্রার্থী ছাড়া অন্য কাউকে আস্থাভোটে সমর্থন দিলে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায়।

ওই বিধান সংশোধনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সূত্র ধরে কমিশনের সহ সভাপতি বলেন, “সকলেই কমবেশি একমত যে কোনো না কোনোভাবে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের এখনকার যে পরিস্থিতি, যেভাবে এটা তৈরি করা হয়েছে, সেখান থেকে এটা পরিবর্তন করে সংসদ সদস্যদের আরো কিছু স্বাধীনতা দিতে হবে।”

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার বিষয়ে ‘একটা বড় রকমের ঐক্যমত’ হওয়ার কথাও বলেছেন আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, “দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো স্বাধীন করা, আরো সক্রিয় করার জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপের বিষয়ে একটা বড় ধরনের ঐকমত্য রয়েছে। নির্বাচন সংস্কারের ব্যাপারেও সকলেই স্বীকার করছেন, তারা বলছেন যে এই ব্যবস্থাগুলো পরিবর্তন করা দরকার।

“ফলে আমি বলব অনেক বিষয়ে নীতিগত জায়গা থেকে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কোথাও কোথাও আসলে কীভাবে করা হবে সেটার বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে। আবার কিছু কিছু মতপার্থক্য তো আছে।”

রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ আলাদা, তাদের মতামতও যে আলাদা হওয়া স্বাভাবিক, সে কথা তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা আশা করছি… আমরা যখন দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছাব, এইগুলো নিয়ে মতপার্থক্যের জায়গাগুলো আমরা দেখব যে কতটা কাছাকাছি আসা যায়।”

বহুত্ববাদ নিয়ে ‘ভুল বোঝাবুঝি’

সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, দেশের সাংবিধানিক নাম এবং সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের মত সুপারিশ রয়েছে।

বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি বলা হয়েছে- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

এগুলোর পরিবর্তে নতুন মূলনীতি হিসেবে 'সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র'র কথা সুপারিশ করেছে কমিশন।

এর মধ্যে ‘বহুত্ববাদ’ নিয়ে আপত্তি করছে ধর্মভিত্তিক দলগুলো। তাদের দাবি, এটা ইসলামের সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে আলী রীয়াজ বলেন, “এটা একটু ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, অনেকেই এ টাকে কেবল ধর্মীয় বিবেচনা থেকে দেখছেন এবং বহুত্ববাদকে কেউ কেউ একত্ববাদের বিরোধিতা হিসেবে দেখছেন। আসলে সংবিধান সংস্কার কমিশন সেই বিবেচনায় করেনি।“

গত কয়েক দশকে ‘সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা’র ধারণায় বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে গেছে মন্তব্য করে এই অধ্যাপক বলেন, “বাংলাদেশের বাস্তবতাতেও আমরা দেখেছি, ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারণাটা অংশত এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।”

“…আমরা তো একটা প্রকৃত বহুত্ববাদী সমাজ। দীর্ঘদিন ধরে বহুত্ববাদী সমাজ। এখানে জাতিগত মতপার্থক্য আছে। জাতিগোষ্ঠীর ভিন্নতা আছে, ভাষার ভিন্নতা আছে। তারপরে ধরুন সামাজিকভাবে এক ধরনের ভিন্নতা আছে। সবাইকে কি আমরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মধ্যে, সমতার মধ্যে, সম্মানের জায়গায় আনতে পারছি? সেই অর্থে আমরা বহুত্ববাদের কথা বলেছি।”


দলগুলোর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হচ্ছে বলেও আশ্বাস দেন আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, “অনেক রাজনৈতিক দল আমাদের সাথে আলোচনা করেছেন যে তারা বুঝতে পারছেন। কিন্তু রাজনৈতিক সামাজিক বাস্তবতাও তো বিবেচ্য, আমরা তো একদম একটা আইডিয়াল সোসাইটিতে নাই। ফলে তারা এটা নিয়ে বলছেন যে এটা যদি না থাকে, অন্যভাবে এটা যদি আপনারা প্রতিফলন করতে পারেন, তাহলে তারা আছেন। কিন্তু হয়ত শব্দের দিক থেকে তারা বিবেচনা করছেন যে এটা ঠিক হবে না। আমরা সেগুলো বিবেচনায় নিচ্ছি, কথাবার্তার অগ্রসর হচ্ছে।”

রাষ্ট্রের মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, “আপনি অ্যাকাডেমিক্যালি যদি দেখেন বা প্রকৃতপক্ষে বাস্তব প্রয়োগও যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন যে আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণায় পরিবর্তন ঘটেছে। এখন শুধু ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে আরও ব্যাপকতর অর্থে সমাজে যে বৈষম্য আছে সেগুলোকে মোকাবেলা করার চেষ্টা হচ্ছে।”


ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে সব মিলিয়ে ১৭ বছর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ছিল, অধিকাংশ সময় তো ছিল না।

“না থাকার কারণে যে যে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়, সেটা কিন্তু থাকার সময়ও হয়েছে। আসলে সংখ্যালঘু বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়, তাদের রক্ষা করতে পারছে কিনা, আমরা ধর্মের বিবেচনাটা করি। কিন্তু অন্য সামাজিকভাবেও তো মার্জিনালাইজড আছেন।…ফলে ধর্মনিরপেক্ষতাটা বাদ দেওয়ার বিবেচনার জায়গাটা ছিল সেটা যে এটাকে আমরা একটু এক্সপান্ড করতে পারি কিনা।”

বাহাত্তর সালে যুক্ত হওয়া ওই চার মূলনীতি ‘আসলে একটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এসেছিল’ বলে মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ।

তার ভাষ্য, “সংবিধান লেখার জন্য গণপরিষদের যে কমিটি, সেই কমিটির বৈঠকের আগেই একটি রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে বলা হয়েছে– এগুলো হবে রাষ্ট্রের আদর্শ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কোনো একক দলের বিষয় ছিল না। এটা একটা জনযুদ্ধ ছিল। এখানে অসংখ্য শক্তি, অসংখ্য মানুষ অসংখ্য রাজনৈতিক দল যুক্ত হয়েছিল।

“বাহাত্তরে বাংলাদেশের গণপরিষদ সেটাকে ধারণ করেনি। ফলে তাদের বক্তব্যগুলো আমরা সেখানে পাইনি। এই চারটা আদর্শের মধ্যে একটা ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু অন্যগুলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি ছাড়াও তো এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, সকলেই করেছে। …এই সমস্ত বিবেচনা করে এটাকে দেখা হয়েছে একটা প্যাকেজ হিসেবে।”

আলী রীয়াজ বলেন, “সংবিধান সংস্কার কমিশন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রের কথা বলেছিল। এর মধ্যে যে তিনটা, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। এটাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি।


“সেটাকে আমরা বলেছিলাম যে আমাদেরকে ফিরতে হবে একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে প্রতিশ্রুতি আমাদের, সেই জায়গায় ফিরতে হবে।”

News Courtesy:

benwes24 | May 15, 2025

 

 

An unhandled error has occurred. Reload 🗙