প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি

প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি

বাছাই কমিটি হবে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে। কমিটির যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার।

কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন।

প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান বা একই ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না—এ প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো মতৈক্য হয়নি।

অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি ‘সমন্বিত প্রস্তাব’ দিয়েছে। এতে একটি সংসদীয় বাছাই কমিটির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবের বেশির ভাগ বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও পুরোপুরি ঐকমত্য হয়নি। প্রস্তাবটি আরও পর্যালোচনা করে দলগুলোকে মতামত দিতে বলা হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারে ঐকমত্য কমিশন।

গতকাল রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এ দুটি বিষয়ে আলোচনা হয়। গতকাল ছিল ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার ১৫তম দিন। বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান নিয়ে আংশিক আলোচনা হয়। এ বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ হলো, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশও একই। এর সঙ্গে তারা বলেছে, দুবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের অযোগ্য হবেন।

শুরু থেকেই এ প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে আসছে বিএনপি। দলটি মনে করে, একই ব্যক্তি তিনটি পদে থাকতে কোনো সমস্যা নেই। গতকালের আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, দলীয় প্রধান হওয়ার কারণে একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অযোগ্য হবেন, এটা গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে যায় না। গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্যেও দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হন, যদিও কোনো কোনো সময় এটা হয়নি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হবেন, এটি একটি রীতি। সংসদ নেতার কার্যত তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এটা আলংকারিক পদ। একই ব্যক্তির একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে কোনো অসুবিধা নেই।

সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে আংশিক একমত জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হতে পারেন। এখানে দুজন হলে কিছু ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এ প্রস্তাব আনা হয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য বা কিছু ক্ষমতা সীমিত করে দেশকে সংস্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী দুজন আলাদা ব্যক্তি হলে সেটা উত্তম হবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হলে বিকল্প নেতৃত্ব বিকশিত হয় না। তিনটি জায়গা আলাদা হলে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হবে।

গতকাল সব দল এ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে পারেনি। আজকের বৈঠকে এ নিয়ে আবার আলোচনা হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সমন্বিত প্রস্তাব

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এর আগেও কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল। তখন এর রূপরেখা নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কাছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি আলাদা আলাদা প্রস্তাব জমা দিয়েছিল। প্রস্তাবগুলোকে মিলিয়ে গতকাল একটি সমন্বিত প্রস্তাব হাজির করে ঐকমত্য কমিশন। সমন্বিত প্রস্তাবটি নিয়ে দলগুলো মোটামুটি একমত হলেও কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়। পরে একটি সংশোধিত সমন্বিত রূপরেখা উপস্থাপন করে কমিশন। দলগুলোকে প্রস্তাবটি লিখিত আকারে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য থাকলে তা আজ সোমবার কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে।

সমন্বিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়া বা অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে এবং মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার বয়সসীমা হবে সর্বোচ্চ ৭৫ বছর।

মেয়াদ অবসানের ক্ষেত্রে
সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ৩০ দিন আগে জাতীয় সংসদের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) ও সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি—মোট পাঁচ সদস্যের ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে। কমিটির যেকোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার।

কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্য ব্যক্তির নাম চাইবে। একটি দল ও একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কেবল একজন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবেন। রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ে তাঁদের প্রস্তাবিত নাম জমা করবেন।

এরপর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কমিটির সদস্যরা সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এবং রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া নামগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন। ওই ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।

বাছাই কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ১২০ ঘণ্টার মধ্যে এই পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত করা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য সংসদের সরকারি দল বা জোট তিনজন, প্রধান বিরোধী দল বা জোট তিনজন এবং সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দল দুজন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। নামগুলো স্পিকার জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করবেন।

এরপর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি দল বা জোটের প্রস্তাবিত তালিকা থেকে প্রধান বিরোধী দল বা জোট যেকোনো একজনকে বেছে নেবে। একইভাবে প্রধান বিরোধী দল প্রস্তাবিত তালিকা থেকে সরকারি দল যেকোনো একজনকে বেছে নেবে। তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রস্তাবিত তালিকা থেকে সরকারি দল বা জোট একজনকে এবং প্রধান বিরোধী দল বা জোট যেকোনো একজনকে বেছে নেবে। একইভাবে তৃতীয় বৃহত্তম দল সরকারি দল এবং বিরোধী দলের তালিকা থেকে একজন করে বেছে নেবে। এভাবে পাওয়া নামগুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একজনের ব্যাপারে যদি প্রস্তাবকারী দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়, তবে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত হবেন।

এ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত না হলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে বাছাই কমিটির সদস্যরা গোপন ব্যালটে ‘র‍্যাঙ্কড চয়েজ’ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে ওই সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে একজনকে বেছে নেবেন।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য পূর্ববর্তী র‍্যাঙ্কড চয়েজ/ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেবেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানালে বা দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে পরবর্তীজনকে নিয়োগ দেবেন।

প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি বাছাই কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ১৫ জনকে উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন।

মেয়াদ অবসান ছাড়া সংসদ ভেঙে গেলে
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিলুপ্ত সংসদের একই ধরনের প্রতিনিধিদের নিয়ে বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে অভিন্ন পদ্ধতিতে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বাছাই করবে।

গতকালের আলোচনা শেষে বিকেলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, এ প্রস্তাবের অধিকাংশ বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। খসড়া প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা করে দলগুলো সোমবার কমিশনকে মতামত জানাবে। কমিশন আশা করছে, আগামীকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।

News Courtesy:

Prothom Alo | July 21, 2025

 

 

 

An unhandled error has occurred. Reload 🗙