গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান চান আলী রীয়াজ
রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে ঠিক না হলে ভবিষ্যতে একধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তাঁর মতে, প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হলে তা অকস্মাৎ সমাধান দেবে না। কিন্তু একটা সম্ভাবনা তৈরি করবে।
আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে আলী রীয়াজ এসব কথা বলেন। ‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যেভাবে হতে পারে’ শিরোনামে যৌথভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও প্রথম আলো।
আলোচনার শুরুতে আলী রীয়াজ বলেন, এখানে তাঁর বক্তব্য ব্যক্তিগত। এ বক্তব্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বা সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে নয়।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ মুহূর্তে গণতান্ত্রিক উত্তরণে দুটি করণীয় দেখছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আসল কাজ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করানো, কার্যকর করা। দ্বিতীয় হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সম্মিলিত শক্তির একটা সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা করা। এটা এখনকার যেসব রাজনৈতিক শক্তি আছে, তাদের মাধ্যমে করার সম্ভাবনা আমি প্রায় দেখি না।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো যে জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে ঠেকা কাজ চলছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে খানিকটা হলেও ঠিকঠাক করতে হবে। রাজনীতিবিদদের যদি একমত করানো যায়, তাহলে সেটা কিছুটা হবে। বাকিটা দীর্ঘ মেয়াদে একটা রাজনৈতিক শক্তির উত্থান প্রয়োজন। যে শক্তির মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের একটা দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সেটা না হলে ঘুরেফিরে আবার ৭–১০ বছর পরে এই সংকট দেখা দেবে।
আলোচনায় অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো তৈরি হয়নি। আমি তো মাঝেমধ্যে শঙ্কিত যে এই দেশে একটা রিপাবলিক তৈরি হয়েছে কি না। কারণ, রিপাবলিকের যে বেসিক ফান্ডামেন্টাল জিনিস, পপুলার সভরেন্টি (গণসার্বভৌমত্ব), সেটার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এই দেশে চর্চিত হয়নি। একটা রিপাবলিক থাকলে যে পার্সোনালিস্টিক অটোক্রেসি এখানে তৈরি হলো, যে ভয়াবহ জায়গায় চলে গিয়েছিল, কয়েকটা লোক মিলে দেশ লুটপাট করেছে—এটা সম্ভব হতো না। এই মাত্রায় এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি।’
আলী রীয়াজ বলেন, ২০২৪ সালে আমাদের সামনে যে সম্ভাবনাটা তৈরি হয়েছে, সেটা হচ্ছে আমরা রাষ্ট্রটাকে বদলাতে পারি, সেই আকাঙ্ক্ষাটা তৈরি হয়েছে। কিন্তু চব্বিশের আন্দোলনটা এক অর্থে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এই স্বতঃস্ফূর্ততা একটা ফোর্স তৈরি করেছে, কিন্তু নেতৃত্ব তৈরি করেনি, কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। সেটা ঘটলে কোনো কমিশনের প্রয়োজন হতো না। ওই শক্তিই নির্ধারণ করে দিতে পারত যে আমি এই এই সংস্কার চাই, এটা করব এবং এই শক্তির জন্য কারও দ্বারস্থ হতে হবে না। এটা হলো না। ১০ মাস পরে এসে আমি বলছি, এই যে রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটা হয়নি।...এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি লড়াই। এই সুযোগে হতে পারত, কিন্তু হয়নি। তার অর্থ এই নয় যে কোনো দিন হবে না। হতে পারে, কিন্তু সম্ভাবনার সেই জায়গাটা তৈরি করতে হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু কীভাবে চায়, জানতে চাওয়া হলে স্পষ্ট কিছু পাওয়া যায় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাওয়ার মানে এই নিশ্চয়তাটা তারা চাইছে যে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা পদ্ধতি থাকতে হবে।
তিনটি কাজ করেছে কমিশন
নির্বাচনী গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে ডেলিবারেটিভ ডেমোক্রেসিতে যাওয়া সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন রেখে আলী রীয়াজ বলেন, আপনাকে একটা নির্বাচনী গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পাঁচ বছরে এক দিনের গণতন্ত্র আমরা বলি। কিন্তু গত ১৬ বছর বা তারও কিছু বেশি সময় ধরে ওই এক দিনও নেই। আমার তো প্রতিষ্ঠান নেই, নির্বাচন কমিশন নেই। সংস্কার কমিশনগুলো ওই জায়গায় কাজ করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো তিনটি কাজ করার চেষ্টা করেছে বলে জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, প্রথমত, কমিশনগুলো একটা এলিট পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট তৈরি করার চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয়ত, পুরো জিনিসটাই বিবেচনা করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিকভাবে। প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করলে এটা অকস্মাৎ সমাধান দেবে না, কিন্তু সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের রূপান্তরের প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক এই অ্যাপ্রোচের যে দুর্বলতা আছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তিন নম্বর হচ্ছে, চেক অ্যান্ড ব্যালান্স।
News Courtesy: